ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্তের সারা বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির ইতিহাসে এটি বড় ধাক্কা। এই ধাক্কা আসবে বাংলাদেশেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতির জন্য নতুন করে বড় শঙ্কা তৈরি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা অব্যাহত রাখতে নতুন করে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে, মন্তব্য জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকাস্থ প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তাত্ক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের রেমিটেন্সে বিরূপ প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিটেন্স কমে গেলেও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে বড় অঙ্কের রেমিটেন্স বাংলাদেশে আসছে। কিন্তু পাউন্ড যেভাবে দর হারাচ্ছে তাতে রেমিটেন্সে বড় ধাক্কা আসছে। তাছাড়া এ ধরনের পরিস্থিতিতে ‘আতঙ্ক’ সৃষ্টির ফলে সেদেশ থেকে রেমিটেন্স পাঠানো কমে যেতে পারে। শুধু ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া নয়, অভিবাসনের ক্ষেত্রেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসতে পারে।
গনমাধ্যমকে দেওয়া এ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শঙ্কার জায়গা হচ্ছে তৈরি পোশাকের রফতানি বাজার। ইইউতে শুল্কমুক্ত সুবিধা এখন আর যুক্তরাজ্য দিতে বাধ্য নয়। গণভোট হলেও সম্পূর্ণরূপে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসতে আড়াই থেকে তিন বছর সময় পাওয়া যাবে। বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো আমাদের রফতানির বড় বাজার হলো ইউরোপ।
ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে অন্যান্য দেশও ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ফলে রফতানির নতুন বাজার সন্ধান করা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। বর্তমানে পর্তুগাল, স্পেন, ইতালির অর্থনীতি দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা ধরে রাখতে হলে আমাদের কূটনৈতিক তত্পরতা জোরদার করতে হবে। অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের বড় শত্রু। অনিশ্চয়তা আরো বাড়লে বিশ্বে বিনিয়োগও কমে যেতে পারে। সবমিলিয়ে বিষয়টি আমাদের জন্য ইতিবাচক হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারে। কেননা গণভোটের ফল প্রকাশের দিনই দেশটির মুদ্রা পাউন্ডের দর কমে গেছে । এটি অব্যাহত থাকলে তাদের ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা কমতে পারে। ফলে রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। দেশটি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার। তবে তিনি বলেন, ব্রেক্সিটের ফলে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে – তা নিশ্চিত হতে হলে আরো অপেক্ষা করতে হবে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তৃতীয় বড় গন্তব্যের দেশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাজ্য হতে ৩২০ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের রফতানি আয় হয়েছে বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির পরেই বাংলাদেশের বড় রফতানি আয়ের দেশ হলো ব্রিটেন। সবচেয়ে বেশি রফতানি হচ্ছে তৈরি পোশাক। এছাড়া হিমায়িত পণ্যের বড় বাজার হলো যুক্তরাজ্য। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের পরেই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর পরেই আসে যুক্তরাজ্য থেকে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকে রেমিটেন্স এসেছে ৮১ কোটি ২৩ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ।
রয়টার্সের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের পর আন্তর্জাতিক অর্থবাজারে সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছে এ গণভোট। এ অবস্থায় নীতিনির্ধারকরা কী করবেন তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন। ব্রিটেন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী দেশ। এই সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখতেও বাংলাদেশকে আলোচনা করতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের অর্থনীতিকে মূল্য দিতে হবে। এখন দেখতে হবে এই মূল্য দিতে তারা কতটা প্রস্তুত। তবে ব্রিটেনের অর্থনীতি যে রকম শক্তিশালী তাতে পাউন্ডের এই দর পতন সাময়িক। কেননা, মুদ্রামান সবসময় সেই দেশটির অর্থনীতির কিছু শক্ত ভিতের উপর নির্ভর করে। বাংলাদেশ বেশিরভাগ লেনদেন করে ডলারে। তাই পাউন্ডের দর পতনের ফলে আমাদের খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। তাছাড়া আমাদের বৈদেশি মুদ্রার রিজার্ভে সিংহভাগ রয়েছে ডলারে। এরপর ইউরো এবং পাউন্ড। সম্প্রতি আমরা চীনা মুদ্রা রেনমিনবিও রিজার্ভ হিসেবে রাখছি। পাউন্ডের দর পতনে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এটি রিজার্ভে বড় প্রভাব পড়বে না বলে তিনি মনে করেন।
স্টকমার্কেটবিডি.কম/এম