নিজস্ব প্রতিবেদক :
ব্যাংকবহির্ভূত ১০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে খারাপ বা ‘রেড জোন’-এ ঢুকেছে। এর মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ৯ টি। চাপ সহনশীল (স্ট্রেস টেস্টিং) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই জোনে ফেলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রতিবেদন তৈরিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদ হার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণ ঝুঁকি, সম্পত্তির (ইক্যুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্য অভিঘাত—এ চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেওয়া হয়। রেড জোনে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে তদারকি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চাপ সহনশীল প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রিন, ইয়েলো ও রেড—এ তিন জোনে ভাগ করা হয়। রেড জোনে পড়েছে এমন ১০ প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি (বিএফআইসি), বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি, এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স, রিলায়েন্স ফিন্যান্স ও ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে এ চাপ সহনশীল প্রতিবেদন তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্তনু সাহা বলেন, ‘রেড জোনে থাকা মানেই খুব খারাপ অবস্থা, তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন অভিঘাতের ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা কী হতে পারে, তার ভিত্তিতে জোনে ভাগ করা হয়। আমরা ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নিতে পারিনি, তাই রেড জোনে পড়ে গেছি। তবে আমাদের খেলাপি ঋণ কিন্তু বেশি নয়। আমরা চেষ্টা করছি সামনের প্রতিবেদনে রেড জোন থেকে বের হয়ে আসার।’
এদিকে, এক বছরে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৪ সালের শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৩ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মফিজউদ্দিন সরকার বলেন, ২০১৫ সালে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো ছিল না। এ ছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকেরা অর্থ বের করে নিয়েছেন, এর ফলেই গত বছর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে।
রেড জোনে পড়া প্রসঙ্গে মফিজউদ্দিন সরকার বলেন, ‘আমাদের চলতি হিসাব আমানত নিতে পারি না, ঋণ করে ব্যবসা করতে হয়। আমরা জামানত ছাড়াই বড় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে থাকি। আমাদের মূলধনও ছোট। ফলে অনেক ভালো প্রতিষ্ঠানও রেড জোনে পড়ে যাচ্ছে।’
জানা গেছে, নিয়মানুযায়ী রেড জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন বছরের মূলধন ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা জমা দিতে হয়। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ আদায়, ঋণ বহুমুখীকরণ, শেয়ারে বিনিয়োগ ও আপত্কালীন তারল্য পরিকল্পনা জমা দিতে হয়। ইয়েলো জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও একইভাবে তদারকি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রিন জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো সূচকে অবনতি ঘটলে কঠোরভাবে তদারকি করা হয়।
জানা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৪৪ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা ঋণ বা লিজ দিয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪ হাজার ১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণের ৮ দশমিক ৯২ শতাংশ ঋণই খেলাপি।
বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৮৮৪ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের ৮৩ দশমিক ১২ শতাংশই খেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকদের অনিয়মের ফলে সরিয়ে দেওয়া হয় কয়েকজনকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বসানো হয়েছে পর্যবেক্ষকও। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাতেও পরিবর্তন এসেছে।
ফার্স্ট ফিন্যান্সের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৮৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৩৫৯ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের ৪১ দশমিক ৩৮ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে।
পিপলস লিজিংয়ের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ খেলাপি হয়ে গেছে ৩৪ দশমিক ১৩ কোটি টাকা। পিপলস লিজিং থেকেও পরিচালকেরা অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক বসিয়েছে। এ ছাড়া মালিকানা পরিবর্তনের পাশাপাশি চেয়ারম্যান পদেও পরিবর্তন এসেছে।
মাইডাস ফিন্যান্সিংয়ের ঋণের পরিমাণ ৬১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১০৫ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। অগ্রণী এসএমইর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৬০ কোটি টাকা। খেলাপি হয়ে গেছে ৭ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৯৫ শতাংশ)।
প্রাইম ফিন্যান্সের খেলাপি ঋণ ১২০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি ঋণ ১১৩ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের খেলাপি ঋণ ৬৭ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। ইউনিয়ন ক্যাপিটেলের খেলাপি ১২১ কোটি টাকা (৮ দশমিক ৪১ শতাংশ)। রিলায়েন্স ফিন্যান্সের খেলাপি ৩২৮ কোটি টাকা (৮ দশমিক ১৫ শতাংশ)।
এদিকে, ২০১৫ সাল শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘স্ট্রেস টেস্টিং’ রেটিংয়ে প্রথম ধাপে অর্থাৎ গ্রিন জোনে পড়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান, দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ ইয়েলো জোনে ১৮টি প্রতিষ্ঠান ও ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রেড জোনে। যদিও ২০১৪ সাল শেষে গ্রিন জোনে ছিল চারটি, ইয়েলো জোনে ১৯টি ও রেড জোনে ছিল আটটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। প্রথম তালিকার প্রতিষ্ঠানগুলো থাকছে সাধারণ ক্যাটাগরিতে। এর পরের ধাপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হচ্ছে দুর্বল ও তৃতীয় ধাপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
স্টকমার্কেটবিডি.কম/এমএ/বি