স্টকমার্কেটবিডি প্রতিবেদক :
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে শনিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী সহযোগিতার সম্পর্ক বিস্তৃত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে আগামী দিনে কানেক্টিভিটি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যৌথ সহযোগিতা বিস্তৃত করার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয়েছে। এটি ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি স্তর থেকে নতুন আরেকটি স্তরে উন্নীত করার বৈঠক।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করা এবং সীমান্ত হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি আবারও জোর দিয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, বাংলাদেশের যত কভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রয়োজন, ভারত তা দেবে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক শেষে পৃথক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ ছাড়া আটটি নতুন প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমান্ত হত্যার বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরেন এবং সীমান্ত হত্যা সমস্যার সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এর জবাবে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, সীমান্তে হাট তৈরি করা গেলে এ সমস্যার অনেকখানি সমাধান হবে।
ড. মোমেন বলেন, দু’দেশের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, তার সবই দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। সেইসঙ্গে এ অঞ্চলের উন্নয়নে দু’দেশ একসঙ্গে কাজ করতেও অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, শুধু তিস্তা নয়, ছয়টি যৌথ নদীর ন্যায্য হিস্যার বিষয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, তিস্তা চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে আলোচনার কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, আলোচনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভারত মনে করে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজের দেশ মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত।
ড. মোমেন বলেন, দু’দেশের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে তার সবগুলোই দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এ সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়েছে। আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরে আসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য।
ড. মোমেন বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এ সফর আমাদের জন্য গর্বের ও গৌরবের। শুধু ভারত নয়, বিগত দশ দিনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বাংলাদেশ সফর করেছেন। এ ছাড়া ষাটেরও অধিক দেশ বাংলাদেশকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তারা বাংলাদেশের অভাবনীয় অগ্রগতিতে অভিভূত বলেও জানিয়েছেন। গত দশ দিনের আয়োজন আমাদের বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য।
তিনি আরও বলেন, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে।
শ্রিংলার ব্রিফিং: ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর এই ঐতিহাসিক সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর দু’দেশের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ও আস্থার সম্পর্কের প্রতিফলন। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চতায় পৌঁছেছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকের আলোচনাতেও আগামী দিনে সহযোগিতার সম্পর্ক বিস্তৃত করার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। আগামীতে অর্থনৈতিক ও কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে যৌথ সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটাসহ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে যৌথ সহযোগিতা বিস্তৃত করার বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই বৈঠক বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি স্তর থেকে নতুন একটি স্তরে উন্নীত করবে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তিস্তার পানি বণ্টনসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত যৌথ নদীর পানির অংশীদারিত্ব নিয়ে সহযোগিতা জোরদার করতে চায়- ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ কথা জানিয়েছেন।
তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত আলোচনা ও তথ্য আদান-প্রদান চলছে বলেও জানান ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। এ প্রসঙ্গে তিনি কিছুদিন আগে দিল্লিতে পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ে বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।
কানেক্টিভিটি বিষয়ে আলোচনার ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানান, দুই দেশের মধ্যে সড়ক, রেল, নৌ যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ যোগাযোগ সুবিধা আরও বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি সার্ক, বিমসটেক ও বিবিআইএন জোটভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃসড়ক যোগাযোগ স্থাপনে যৌথভাবে কাজ করতেও একমত হয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যই সবচেয়ে বেশি ভিসা ইস্যু করে। কভিড-১৯ এর মধ্যেও মেডিকেল ও বিজনেস ভিসা স্বাভাবিক নিয়মেই দেওয়া হচ্ছে। কভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতির অবসান হলে ভ্রমণ ভিসাও চালু হবে। তিনি জানান, ভারতে বাংলাদেশি নাগরিকদের চিকিৎসা সুবিধা আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ভারত এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই চিন্তাভাবনা করছে।
রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টিকে ভারত সব সময় শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে। রোহিঙ্গা সংকট ইস্যু গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ভারত বাংলাদেশকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্যও ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, নিরাপত্তা সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং আগামী দিনে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে যৌথ সহযোগিতার সম্পর্ক আরও বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি আরও জানান, যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
যেসব সমঝোতা স্মারক ও উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা: সই হওয়া সমঝোতা স্মারকগুলো হলো- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনে সহযোগিতা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক্ক বাধা দূর করতে সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) সহযোগিতা, বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই সরবরাহ, প্রশিক্ষণ এবং রাজশাহীতে কলেজ মাঠের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন।
এ ছাড়া শিলাইদহের সংস্কারকৃত কুঠিবাড়ী, মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া হয়ে কলকাতা পর্যন্ত স্বাধীনতা সড়ক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসমাধি, ভারতের উপহার ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স, চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল, তিনটি সীমান্ত হাট উদ্বোধন এবং স্মারক ডাকটিকিটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
মোদির ঢাকা ত্যাগ: ভারতের প্রধানমন্ত্রী গত রাতে দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
স্টকমার্কেটবিডি.কম/