স্টকমার্কেটবিডি প্রতিবেদক :
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর প্রভাবে বৃদ্ধি পাবে পণ্যের দাম। বিপাকে পড়বে রপ্তানিমুখী শিল্প। দেশীয় উদ্যোক্তারা বাজারে পণ্যের দাম বাড়াতে পারলেও রপ্তানিকারকরা তা পারবেন না। বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াবে না। দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিলে তারা অন্য দেশে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এই অবস্থায় রপ্তানিমুখী শিল্প আবার নতুন করে সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৩ নভেম্বর রাতে হঠাৎ সরকার ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ থেকে ৮০ টাকা করেছে। বৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। জ্বালানি তেলে মোট চাহিদার প্রায় ৪১ দশমিক ৬৫ শতাংশই ব্যবহৃত হয় শিল্প ও রপ্তানি খাতে। এর মধ্যে শিল্প খাতে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ, বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতে ২ শতাংশ, শিল্পপণ্য পরিবহণে ৩২ শতাংশ। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এসব খাতে সার্বিক ব্যয় বাড়বে
সূত্র জানায়, ডিজেলের দামের কারণে প্রতি টনে খরচ বেড়েছে ১৮ হাজার টাকা। রপ্তানিমুখী শিল্পের পণ্য পরিবহণে বছরে প্রায় ১০ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এ হিসাবে এ খাতে খরচ বাড়বে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অন্যান্য শিল্পের পণ্য পরিবহণে প্রায় ১২ লাখ টন ডিজেল ব্যবহৃত হয়। এ খাতে বাড়বে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। বেসরকারি খাতে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের জন্য ডিজেল ব্যবহার করে। এতে বছরে ব্যবহৃত হয় প্রায় ২ লাখ টন। এ হিসাবে খরচ বাড়বে বছরে ৩৬০ কোটি টাকা। শিল্পে ডিজেল ব্যবহৃত হয় প্রায় ৪ লাখ ৬৩ হাজার টন। এ খাতে খরচ বাড়বে ৮৩৩ কোটি টাকা। সব মিলে দেশের শিল্প খাতে বাড়তি খরচ হবে ৪৯৯৩ কোটি টাকা।
উদ্যোক্তারা বলেছেন, করোনার পরবর্তী সময়ে এখনো শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এ অবস্থায় ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে শিল্প খাত আরও সংকটে পড়বে। পণ্য ও কর্মীদের পরিবহণ ব্যয়, বিদ্যুৎ খরচ বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন খরচও। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে রপ্তানিমুখী শিল্প খাত। এ খাতের উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও বিদেশি ক্রেতারা দাম বাড়াতে চাচ্ছেন না। উলটো তারা আরও কমাতে চাচ্ছেন। একদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে ক্রেতারা দাম না বাড়িয়ে কমাতে চাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকরা তীব্র সংকটে পড়েছেন। এ নিয়ে তারা ক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে ক্রেতাদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সাড়া মেলেনি।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাস-লঞ্চের ভাড়া নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে পণ্য পরিবহণে এ খাতে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়ের সুযোগ থাকছে। ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে কাউকে কিছু না জানিয়ে ট্রাক মালিকরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে, যা মোটেও কাম্য নয়। এতে রপ্তানির অনেক কনটেইনার পোর্টে যেতে বিলম্ব হয়েছে। বন্দরে কনটেইনার জট লেগে গেছে। এতে রপ্তানি খাত সংকটে পড়েছে।
রপ্তানিকারকরা জানান, ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে পণ্য পরিবহণ ভাড়া গড়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ছে। আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ট্রাক ভাড়া ছিল ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এখন তা বেড়ে ২০ থেকে ২১ হাজার টাকা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ধর্মঘটে যায়। এতে প্রতিদিন ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাকের শিপমেন্টে ক্ষতি হয়েছে। এটা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। সরকার যেই হারে তেলের দাম বাড়িয়েছে, সে অনুযায়ী ট্রাক ভাড়া বাড়ালেই হতো। ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিকরা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মঘট পালন করে পুরো দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি আরও বলেন, তেলের দাম বাড়ানোর কারণে ওয়াশিং, এক্সেসরিজ, কাঁচামাল ও তৈরি পণ্য পরিবহণসহ প্রতিটি খাতেই খরচ বাড়বে। এতে গার্মেন্ট শিল্পে সামগ্রিকভাবে উৎপাদন খরচ বাড়বে।
বিজিএমইএ-এর সাবেক সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে পরিবহণ ভাড়া ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে। এর সঙ্গে অন্যান্য খরচও বাড়বে। সব মিলে রপ্তানিমুখী শিল্পের অবস্থা কঠিন হবে। জ্বালানির দাম বাড়িয়ে দেশের শিল্প ও রপ্তানি খাতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে ডিজেলের দাম আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে।
উদ্যোক্তারা জানান, ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণে সব ধরনের সহযোগী পণ্যের দাম বাড়বে। যেসব খাতে ডিজেলনির্ভর বয়লার ব্যবহৃত হয় সেগুলোয়ও খরচ বাড়বে বেশি। শুধু উৎপাদন ব্যয় বাড়বে গড়ে ৫ শতাংশ। অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়বে ৩ থেকে ৫ শতাংশ। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ছোট উদ্যোক্তাদের কাছে নানা ধরনের পণ্যের জোগান নেয়। ইতোমধ্যে ছোট উদ্যোক্তরাও জানিয়েছেন বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ানোর কথা। সব মিলে শিল্প খাতে খরচ ২৩ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে বলে উদ্যোক্তারা আশঙ্কা করছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, প্রতিনিয়ত পোশাকের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। উলটোদিকে ক্রেতারা পণ্যের দাম কমাচ্ছে। এতে গার্মেন্টগুলো টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। তিনি বলেন, দুটি খোড়া যুক্তিতে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি এবং দ্বিতীয়ত ভারতে পাচারের কারণে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ২০ ডলার ছিল, তখন কেন তেলের দাম কমানো হয়নি? আর পাচার ঠেকাতে বর্ডার গার্ডকে আরও ভূমিকা রাখতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অন্তত এক বছর পর তেলের দাম বাড়ানো উচিত ছিল।
স্টকমার্কেটবিডি.কম/এ