বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে মন্দ উদাহরণ রবি

স্টকমার্কেটবিডি ডেস্ক :

দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বরাবরই বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। কখনো কখনো দেয়া হয় বড় অংকের বোনাস লভ্যাংশও। আর লোভনীয় এ লভ্যাংশের আকর্ষণে বিনিয়োগকারীদের কাছে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত শেয়ার হলো বহুজাতিক কোম্পানির। এ কারণে শেয়ারবাজারে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারের দামও বেশ চড়া।

শেয়ারবাজারের ইতিহাসে শেয়ার ইস্যু বিবেচনায় সবচেয়ে বড় কোম্পানি হিসেবে গত বছরের ডিসেম্বরে তালিকাভুক্ত হয় টেলিযোগাযোগ খাতের বহুজাতিক কোম্পানি রবি আজিয়াটা লিমিটেড। তালিকাভুক্তির দুই মাস পার হওয়ার আগেই প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগকারীদের হতাশ করে লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে বহুজাতিক হিসেবে বিরল ও মন্দ উদাহরণ তৈরি করল রবি। কোম্পানিটির এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি)। গতকাল কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকে এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চরম অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।

দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর গত পাঁচ বছরের লভ্যাংশ প্রদানের হার পর্যালোচনায় দেখা যায়, সিমেন্ট খাতের বহুজাতিক কোম্পানি লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড এ সময়ে ধারাবাহিকভাবে ১০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। সিরামিক খাতের আরএকে সিরামিকস বাংলাদেশ লিমিটেড গত পাঁচ বছরে বোনাস ও লভ্যাংশ মিলিয়ে ২৫ থেকে ১৫ শতাংশ হারে লভ্যাংশ দিয়েছে। প্রকৌশল খাতের বহুজাতিক সিঙ্গার বাংলাদেশ লিমিটেড গত পাঁচ বছরে বোনাস ও নগদ মিলিয়ে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। তামাক খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকা বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড (বিএটিবিসি) পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীদের ৬০০ থেকে ৪০০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়ে আসছে। এর পাশাপাশি ২০১৮ ও ২০২০ সালে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ২০০ শতাংশ হারে বোনাস লভ্যাংশও দিয়েছে। ব্যবসায় সুবিধা করতে না পেরে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) বাংলাদেশ লিমিটেডও (বর্তমানে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেড) গত পাঁচ বছরে ৫৫০ থেকে ৫০০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এমনকি ওষুধ উৎপাদন ইউনিট বন্ধ করে দেয়ার কারণে কর্মচারীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৩১ কোটি ৭৬ লাখ টাকাসহ মোট ২০১ কোটি টাকা সমন্বয় করায় ২০১৮ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ৭১ কোটি টাকা কর-পরবর্তী লোকসান হয়েছিল। তবে লোকসান সত্ত্বেও ওই হিসাব বছরে রিজার্ভ থেকে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ৫৩০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

জ্বালানি খাতের বহুজাতিক লিন্ডে বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে ৩১০ থেকে ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। বহুজাতিক রং উৎপাদক বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের গত পাঁচ বছরে ৬০০ থেকে ২০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের পাশাপাশি ১০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশও দিয়েছে। ভারতের মুম্বাইভিত্তিক বহুজাতিক ম্যারিকো বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে ৯৫০ থেকে ৪৫০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। ওষুধ ও রসায়ন খাতের তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের জন্য গত পাঁচ বছরে ৬৫০ সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৫০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। বহুজাতিক জুতা উৎপাদক বাটা শু বাংলাদেশ পাঁচ বছরে ১২৫ থেকে ৩৪৫ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। টেলিযোগাযোগ খাতের বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ ২৮০ থেকে সর্বনিম্ন ১৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছে। এমনকি গত বছর নিরীক্ষা দাবির বিপরীতে বিটিআরসিকে ২ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের পরও ২০২০ হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ২৭৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশের ঘোষণা দিয়েছে কোম্পানিটি। এক্ষেত্রে ঘোষিত লভ্যাংশ কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফার ৯৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পরদিন গতকাল কমিশনের জরুরি তলবে আগারগাঁওয়ের সিকিউরিটিজ কমিশন ভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন রবি আজিয়াটার কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ সাহেদুল আলমসহ অন্য কর্মকর্তারা। কমিশনের পক্ষে বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, কমিশনার অধ্যাপক ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ও আব্দুল হালিম, নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান ও মোহাম্মদ রেজাউল করিম এ সময় উপস্থিত ছিলেন। কমিশনের পক্ষ থেকে লভ্যাংশ না দেয়ার কারণে রবির প্রতি চরম অসন্তোষ ব্যক্ত করা হয় এ সময়। এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে কোম্পানিটির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা হতাশ হয়েছেন। কীভাবে এর প্রতিকার করা যায় সেটি কোম্পানির পর্ষদের সঙ্গে আলোচনা করে কমিশনকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্তে রবির প্রতি চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে কমিশন। রবির এ ধরনের সিদ্ধান্তের প্রতিকার হিসেবে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব সেটি কোম্পানির পর্ষদের সঙ্গে আলোচনা করে যত দ্রুত সম্ভব কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে।

এদিকে লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন গতকাল এ বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে রবি আজিয়াটা। সেখানে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএসইসি রবির লভ্যাংশ না দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণে খুশি হয়নি। তারা লভ্যাংশ প্রত্যাশা করেছিল, তাই এটি স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের যে পরিমাণ মুনাফা হয়েছে তার অর্ধেক লভ্যাংশ হিসেবে দিতে গেলে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ হারে দিতে হতো। আর মুনাফার পুরোটাই লভ্যাংশ হিসেবে দিলেও ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশের বেশি দেয়া সম্ভব হতো না। এত অল্প লভ্যাংশ দিয়ে সবাইকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব ছিল কিনা সেটি নিয়ে পর্ষদ সভায় আলোচনা হয়েছে। উদ্যোক্তা-পরিচালকরা কোম্পানিতে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন এবং তারা ২০১৪ সালের পর থেকে লভ্যাংশ নেননি। তা সত্ত্বেও শুধু সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ দেয়া যায় কিনা, সেটি পর্ষদে উপস্থাপন করা হয়েছিল। পুনর্বিনিয়োগ করার বিষয়টিও লভ্যাংশ না দেয়ার অন্যতম কারণ।

রবির সিইও বলেন, লভ্যাংশ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে শুধু লভ্যাংশ দিয়ে শেয়ারকে বিবেচনা করলে হবে না। কোম্পানির পারফরম্যান্স দেখতে হবে। যারা শুধু লভ্যাংশ দিয়ে বিবেচনা করে, তারা বিচক্ষণ বিনিয়োগকারী নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। সূত্র : বণিক বার্তা

স্টকমার্কেটবিডি.কম/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *