প্রতিবেশী ভারত গত বছরের মতো এবারও হঠাৎ করে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এর তাত্ক্ষণিক প্রভাবে অস্থির হয়ে উঠেছে দেশের পেঁয়াজের বাজার। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধে আগে থেকেই সতর্ক ছিল। মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে মিয়ানমার ও তুরস্ক থেকে এক লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি চূড়ান্ত করেছে।
ভারত সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে গতকাল সোমবার বলা হয়, দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বাড়ায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্ত প্রজ্ঞাপন জারির সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। তবে ভারতের ব্যবসায়ীরা বলছেন অন্য কথা। তাঁরা বলছেন, পেঁয়াজের চলতি আমদানি মূল্য টনপ্রতি ২৫০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ ডলার নির্ধারণ করা হলেই পুনরায় রপ্তানি শুরু করা হবে।
বেনাপোলের পেঁয়াজ আমদানিকারক রফিকুল ইসলাম রয়েল বলেন, ভারত থেকে ২৫০ ডলার মূল্যে পেঁয়াজ আমদানি হয়ে আসছে। ভারতের নাসিকে বন্যার কারণে সেখানে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকরা স্থানীয় বাজারদর হিসাবে ৭৫০ ডলারের নিচে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করবেন না। এ কারণে তারা পেঁয়াজ রপ্তানি সাময়িক বন্ধ রেখেছে।
বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল রপ্তানিকারক সমিতির পক্ষে ব্যবসায়ী কার্তিক ঘোষ বলেন, পেঁয়াজ রপ্তানিকারক সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে প্রতি টন ৭৫০ ডলারের নিচে তারা বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করবে না। সে কারণে বাংলাদেশ অভিমুখী পেঁয়াজবোঝাই অনেক ট্রাক সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে।
ভারতের বনগাঁর পেঁয়াজ ব্যবসায়ী অনিল মজুমদার টেলিফোনে জানান, বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে তাঁদের আপত্তি নেই। বাজারদরে এলসি পেলে তাঁরা পুনরায় রপ্তানি শুরু করবেন। সে ক্ষেত্রে পুরনো যেসব এলসি দেওয়া আছে সেগুলোর মূল্য ২৫০ ডলার সংশোধন করে ৭৫০ ডলার করা হলে পেঁয়াজ আমদানিপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করেছে, নাকি ন্যূনতম মূল্য বেঁধে দেবে সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে আমাদের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। পাশাপাশি ভারতের বিকল্প হিসেবে তুরস্ক ও মিয়ানমার থেকে এক লাখ টন পেঁয়াজ সরবরাহ লাইনে আছে। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ চলতি মাসের শেষ নাগাদ দেশের বাজারে ঢুকবে। এ ছাড়া প্রতিদিনই তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টন পেঁয়াজ আসছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, দেশে পেঁয়াজের মজুদ পর্যাপ্ত থাকলেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এ ব্যাপারে আমরা এবার সতর্ক রয়েছি।’
ঢাকার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ব্রাদার্স ট্রেডার্সের ইয়াসিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারতের সরকার গতকাল সকালে হঠাৎ করেই সে দেশ থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। সকালে ৪০ থেকে ৪২ ট্রাক পেঁয়াজ দেশে ঢুকলেও সোনামসজিদ বর্ডারের বাইরে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক আটকা পড়ে আছে। পেঁয়াজবোঝাই ওই সব ট্রাক আর ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’
আরেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রফিক ট্রেডার্সের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভারতের বেঙ্গালুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে নতুন পেঁয়াজের আবাদ নষ্ট হয়ে গেছে। এর প্রভাবে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় গতকাল খুচরা পর্যায়ে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪৫ রুপি (৬৪ টাকা) দরে।’ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তুরস্ক, মিয়ানমার, মিসরসহ পেঁয়াজ রপ্তানিকারী অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য আনার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, এসব দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে গড়পড়তা ২০ থেকে ২৫ দিনের মতো সময় লাগে। তাই মন্ত্রণালয়ের দ্রুত উদ্যোগ প্রয়োজন।
এদিকে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় দেশের ভোগ্য পণ্যের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গতকাল সকালে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩৮ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও বিকেল থেকেই পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে দেন আড়তদাররা।
তবে খাতুনগঞ্জ কাঁচা পণ্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, এখানে আড়তদাররা কমিশনে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। ভারত রপ্তানি বন্ধ করলেও বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ আছে। দেশীয় পেঁয়াজের সরবরাহও প্রচুর। ফলে গত বছরের মতো অস্থিরতা তৈরির সুযোগ দেখছি না। এর পরও বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।
এদিকে হিলির কাস্টমস কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট শংকর দাস বলেন, ভারতের বাজারে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে গতকাল দুপুরে হিলি কাস্টমসকে রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ভারত সরকার। তবে গতকাল পর্যন্ত এসংক্রান্ত সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। অবশ্য নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সিঅ্যান্ডএফকে জানিয়ে দেয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ থাকবে। এরই মধ্যে যেসব এলসি খোলা রয়েছে এবং টেন্ডারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, সেগুলোর বিপরীতেও পেঁয়াজ রপ্তানি হবে না।
শংকর দাস বলেন, ‘সরকারের হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে আমরা বিপাকে পড়েছি। কারণ বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানির জন্য এলসি খোলা রয়েছে। ওই সব এলসির বিপরীতে রপ্তানির সুযোগ দিতে সরকারকে বলা হয়েছে। অন্যথায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।’
হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল এখান দিয়ে পেঁয়াজ নিয়ে কোনো ট্রাক দেশের ভেতরে ঢোকেনি। এতে সীমান্তের ওপারে আমার বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আটকা পড়েছে। তবে রবিবার রাত পর্যন্ত সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল।’
এই স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নীরব ট্রেডার্সের জাকির হোসেন বলেন, ‘পেঁয়াজের রপ্তানি মূল্য বাড়িয়ে নিতে এটা ভারতের একটা কৌশল। আমার ধারণা, দ্রুতই পেঁয়াজ রপ্তানির নির্দিষ্ট দর বেঁধে দিয়ে তারা পুনরায় রপ্তানি শুরু করবে।’ সূত্র : কালেরকন্ঠ
স্টকমার্কেটবিডি.কম/