স্টকমার্কেটবিডি ডেস্ক :
দেশের সিংহভাগ অর্থপাচার হয় ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং চ্যানেলে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে ওভার ইনভয়েসিংয়ের তালিকা চাওয়া হয়েছে। তালিকা ধরে অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।
সোমবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে ‘কৌশলপত্র-২০১৯’ নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দুদক এই সমাজেরই অংশ, ধোয়া তুলশী পাতা নয়। দুদক নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করে, অস্বীকার করে না।’
তিনি বলেন, ‘দুদক স্পষ্টভাবে বলতে পারে—গত তিন বছরে সরকার অথবা ক্ষমতাবানরা দুদককে প্রভাবিত করেনি। আমরা নিজেরাই নিজেকে প্রভাবিত করেছি। অন্য কেউ আমাদের প্রভাবিত করার সাহস করেনি।’
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকেই বলেন মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যর্থতার জন্য দুদকের দিকে আঙুল তোলা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে—মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন করে মানিলন্ডারিং মামলা পরিচালনার একক দায়িত্ব দুদকের হাতে না রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ একাধিক সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুদক কেবল ঘুষ ও দুর্নীতি সম্পৃক্ত মানিলন্ডারিংয়ের অপরাধ তদন্ত করতে পারে।’
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে। দুদক দৃঢ়ভাবে বলতে পারে—একক সেক্টর হিসেবে ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে সর্বোচ্চ মামলা ও গ্রেফতার হয়েছে। ১২০ জন ব্যাংক কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি, জিএমসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও গ্রেফতার হয়েছেন। আবার সরকারের সচিব, যুগ্মসচিব, মহাপরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে।’
মতবিনিময় সভায় সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার মো. জমির বলেন, ‘বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় দুদকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বচ্ছতা না থাকলে দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয় না।’
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দুদকের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্র এখন পয়সা উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার মানের চরম অবনতি ঘটছে। যদি সক্ষম এবং দক্ষ শ্রমশক্তি না থাকে, তাহলে এ দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার বিনিয়োগ আসবে না।’ বাংলাদেশকে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকারি স্কুল ও কলেজে দুদকের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য সেক্টরে প্যাথলজিক্যাল টেস্টের কমিশনের অর্থ চিকিৎসকদের পকেটে যাচ্ছে। এখানে স্যাডো এরিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকেও নজর দেওয়া উচিত।’
দুদকের মামলার দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে প্রধান তথ্য কমিশনার বলেন, ‘দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়োজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সবাই অনুধাবন করেন কেউ-ই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘‘কমিশনের মিশনে ‘দুর্নীতির গতি প্রকৃতি নির্ণয়’ থাকা উচিত। কাজের মধ্যে স্বচ্ছতার দৃশ্যমান মানদণ্ড থাকবে। স্বচ্ছতা আপেক্ষিক। তাই এর একটি মানদণ্ড থাকা উচিত। কমিশনের প্রতি মানুষের ভয় ও শ্রদ্ধা থাকলে দুর্নীতি প্রতিরোধ কিছুটা সহজ হবে।’ তিনি স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতে দুদকের দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘চিকিৎসকদের প্যাথলজিক্যাল টেস্ট এবং ওষুধের স্যাম্পল মাইন বোমের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।’
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘দুর্নীতি দমনকে আইনি প্রক্রিয়ায় না দেখে এটিকে উন্নয়নের প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতি দমন করা না গেলে ২০৪১ সালের উন্নত দেশ বিনির্মাণ কঠিন হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী কোচিং বাণিজ্য বন্ধে দুদকের সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারের পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতে দুদকের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।’
মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কর্মচারীদের বড় বড় দুর্নীতি বেরিয়ে আসছে, এসব ক্ষেত্রে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা সচিবদের কি কোন দায়বদ্ধতা নেই।’ নতুন তিনটি ব্যাংকের অনুমোদনের সমালোচনা করে তিনি এ বিষয়ে দুদককে তদন্তের আহ্বান জানান।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দুদকের উচিত মেগা খাতের দুর্নীতি দমনে অধিকতর মনোনিবেশ করা।’ তিনি দুদকের মতো সার্বিকভাবে সরকারকেও একটি কৌশলপত্র প্রণয়নের সুপারিশ করেন।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘দুদকের প্রতি মানুষের ক্ষোভ কিংবা হতাশা থাকতেই পারে। কারণ, আমরা অতীতে রাষ্ট্রের মধ্যে ছিলাম না। রাষ্ট্র কী জানতাম না, সিটি কী জানতাম না। সবই আমাদের কাছে নতুন। তাই রাতারাতি সবকিছু আশা করলে হতাশ হতেই হবে। তবে আশার কথা, রাষ্ট্র ধীরে ধীরে দৃঢ় হচ্ছে। রাষ্ট্র আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে সংহত হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুদকের কাছে মানুষের আশা গগনচুম্বী। বাংলাদেশের প্রধান দুঃখ দুর্নীতি। তবে আনন্দের সঙ্গে বলতেই হয় দুদক জোরালোভাবে চেষ্টা শুরু করেছে। বাংলাদেশ যেমন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে, দুদকও ঠিক তাই করবে। রাতারাতি এটা করা কঠিন।’
দুদক কয়েকটি দৃশ্যমান ঘটনা ঘটিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আরও অন্তত এমন ২০টি ঘটনা ঘটালেই দুদকের প্রতি জনআস্থা বৃদ্ধি পাবে।’
সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘রাজনৈতিক পর্যায়ে আলোচিত দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা মুক্ত থাকলে দুর্নীতি দমন হবে অবাস্তব চেষ্টা।’
সাবেক মন্ত্রী মিজানুর রহমান শেলী বলেন, ‘রাজনৈতিক দুর্নীতি দমনে কমিশনকে আরও কাজ করতে হবে। ক্ষমতা এবং শক্তির উৎসেই আঘাত করতে হবে।’
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করতে হবে।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বড় দুর্নীতি আগে ধরতে হবে।’
মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, ‘দুর্নীতি একটি খারাপ সংস্কৃতি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে দুদক হস্তক্ষেপ করলে সমস্যা কোথায়। রাজনৈতিক চিন্তা মাথায় না রেখে সমাজের কথা বিবেচনা করে কাজ করতে পারলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।’
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির ও কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেন। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
স্টকমার্কেটবিডি.কম/