অনিয়মে জড়িতদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে

bbনিজস্ব প্রতিবেদক :

দেশের ৩৩টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে গতকাল আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রথমার্ধের আর্থিক প্রতিবেদনের বিভিন্ন নির্দেশক সম্পর্কে আলোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে এনবিএফআইয়ে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফারেন্স হলে অনুষ্ঠিত ওই সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক ও ৩৩টি এনবিএফআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে লিখিত বক্তব্যে ফজলে কবির বলেন, এনবিএফআই খাতে মাত্রাতিরিক্ত অনিয়ম হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছে।

তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যেকোনো ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থানে থাকবে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর ফল ভোগ করতে হবে।’

এনবিএফআই খাতে খেলাপি ঋণ প্রায় ৮ শতাংশ, যা মোটেই সন্তোষজনক নয় উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা বিদ্যমান নীতিমালা লঙ্ঘন করেছেন— বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিংয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষ করে পরিচালকদের ব্যক্তিগত ঋণ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণ প্রদানে অনিয়ম, শ্রেণীকৃত ঋণকে অশ্রেণীকৃত ঋণ হিসেবে দেখানোসহ বেশ কয়েকটি অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু অনিয়মের সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। স্প্রেড ৫ শতাংশে সীমিত রাখার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

এনবিএফআই খাতের বিনিয়োগ সম্পর্কে গভর্নর জানান, শিল্প খাতে এনবিএফআইয়ের বিনিয়োগ ৪৩ শতাংশ, ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৮ শতাংশ ও হাউজিংয়ে ১৭ শতাংশ। কিন্তু কৃষিতে ২ শতাংশেরও কম। তাই এ খাতে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

এর বাইরে ব্যাসেল নীতিমালা অনুযায়ী সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম আবশ্যকীয় মূলধন তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের ওপর উন্নীত করার কথা বলেন।

বৈঠক শেষে ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এসব খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরিচালকদের নিজ প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের শেয়ারের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ নেয়ার বিধান রয়েছে। কেউ যেন তথ্য গোপন করে এর চেয়ে বেশি ঋণ নিতে না পারে, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।

তিনি বলেন, বেশকিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের কারণে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে যেন অনিয়মের পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। তবে রেড জোনে বা বেশি ঝুঁকিতে থাকা ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়।

এ সময় এসব প্রতিষ্ঠানকে ফটকাবাজি না করে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করারও নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকের মতো আচরণ না করে বরং ব্যবসায় মনোযোগ দেয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বৈঠক শেষে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান মফিজউদ্দিন সরকার বলেন, বীমা কোম্পানিগুলোর ডিপোজিটের ২ শতাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়টি বীমা কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আইডিআরএকে জানানো হবে বলে গভর্নর আশ্বাস দিয়েছেন।

এছাড়া বন্ড মার্কেটে পুনরায় কর অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে, যদিও এটি এনবিআরের ওপর নির্ভর করে, তবুও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির।

তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গুড গভর্ন্যান্স বা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার বিষয়টি স্বীকার করে মফিজউদ্দিন সরকার বলেন, নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই মোতাবেক আমরা উদ্যোগ নেয়ার চেষ্টা করব। এছাড়া বর্তমানে বিদ্যমান সার্ভিস চার্জ বা প্রসেসিং ফি শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ ও সর্বোচ্চ ২ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ ও সর্বোচ্চ ৫ লাখ করার আবেদন করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, দেশের ব্যাংকিং খাতের লাগামহীন খেলাপি ঋণের হাওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও লেগেছে। দেশের ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গত জুন পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ৪৯ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা, যা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণকৃত ঋণের প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে পরিচালকদের অর্থ আত্মসাত্, ঋণ বিতরণে অনিয়ম, পরিচালনা পর্ষদে দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো— বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স, পিপলস লিজিং ও ফার্স্ট ফিন্যান্স। এ তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে পরিচালকরা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বের করে নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফসি) ৫৮৫ কোটি, পিপলস লিজিংয়ের প্রায় ৪০০ কোটি ও ফার্স্ট ফিন্যান্সের প্রায় ২৫০ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। নিয়ম না মেনে ঋণ বিতরণ করায় এ তিন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।

এছাড়া জুন পর্যন্ত বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের বিতরণকৃত ৭৪০ কোটি টাকার মধ্যে খেলাপি ৪১৫ কোটি, ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ৮০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপি ৭০ কোটি, রিলায়েন্স ফিন্যান্সের ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপি ৫০০ কোটি, উত্তরা ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে খেলাপি ১৭৫ কোটি, বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের বিপরীতে ৯০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে শ্রেণীকৃত করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *