শিল্পঋণে খেলাপি বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা

স্টকমার্কেটবিডি প্রতিবেদক :

দেশের ব্যাংকিং খাতের সিংহভাগ ঋণ দেওয়া হয় বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে। বৃহৎ শিল্প খাতে ঋণ দিতেও বেশি আগ্রহী সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতের ব্যাংকগুলো। অথচ ব্যাংক খাতের খেলাপি সবচেয়ে বেশি এ বৃহৎ শিল্প খাতে। নিয়মিতভাবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বাড়ছে, যা সম্প্রতি এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর জন্য দায়ী করা হয় বৃহৎ শিল্পকে। কেননা, ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৪৬ দশমিক ১৬ শতাংশ এ খাতের দখলে। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ চিত্র দেখা যায়। ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিক শেষে শিল্প খাতে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ টাকা আদায়ের হারও কম ব্যাংকগুলোর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং তফসিলি ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘এসব ঋণ মূলত বৃহৎ কোম্পানিগুলোকে দেওয়া। এ কোম্পানিগুলোর মালিক আবার রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে খুবই প্রভাবশালী। এসব কারণে তাদের থেকে ঋণের টাকা আদায় করা কঠিন।’

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হয় খেলাপি ঋণকে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও কমানো যাচ্ছে না খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বরং দিনকে দিন আরও বেড়েই চলেছে। পুরো করোনার সময়ে বড় বড় সুযোগও কাজে লাগায়নি ঋণখেলাপিরা। উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে টাকা দেওয়া বন্ধ করেছে। কিন্তু এসব গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে ঘোষণা করতে পারেনি ব্যাংকগুলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড়ের কারণে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সময়ের আলোকে বলেন, ‘শিল্প খাতে ঋণ দিতে আমরাও আগ্রহী। কারণ এতে অপারেশন কস্ট এবং ঝামেলা কম। তবু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব ঋণ প্রদানে অনিয়ম হয়। আমরাও করি বাধ্য হয়ে। এসব ঋণ পেতে রাজনৈতিক এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রেসার থাকে। ব্যাংকাররা এ খাতে ঋণ দিতে তাই বাধ্য হয় একপ্রকার। সঠিকভাবে ঋণ বিতরণ না করায় তা আদায় করাও যায় না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। নানা উদ্যোগের পরও খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে পারছে না নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এতে দেশের ব্যাংকিং খাত দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। বড় শিল্পে ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও বেশি মুনাফার সুযোগের ফলে বরাবরই বড় শিল্পঋণে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চ শেষে শিল্পঋণে খেলাপির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা। যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৪৯ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিল্প খাতে খেলাপি ছিল ৫২ হাজার ৩৭২ কোটি। হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপির ৪৬ দশমিক ১৬ শতাংশই শিল্প খাতের অবদান।
শিল্পের তিনটি উপখাতের মধ্যে বৃহৎ শিল্পপতিদের ঋণ বেশি খেলাপি হয়েছে। বৃহৎ শিল্পে খেলাপি ঋণ ২৬ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা থেকে তিন মাসের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। মাঝারি শিল্পগুলোর খেলাপি ঋণ প্রায় ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। তিন মাস আগে ছিল ১৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ক্ষুদ্র শিল্পে খেলাপি ঋণ ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। যা তিন মাস আগে ছিল ৭ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ৯০ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ৩০ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এদিকে শিল্পঋণ বিতরণের বিপরীতে আদায়ের হারের অবস্থাও ভালো। চলতি বছরের মার্চ শেষে আদায় বেড়েছে ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্প খাতে ঋণ আদায় হয়েছে এক লাখ ১৮ হাজার ৭৭ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ৮৪ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতে ঋণ আদায় বেড়েছে ১৭ হাজার ৮২ কোটি টাকা বা ২০ দশমিক ১৪ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন, করোনার ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি। এর ফলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শিল্প খাত। করোনা শুরুর পর ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম খারাপ অবস্থা তৈরি হয়। সে তুলনায় চলতি বছর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তাই বিভিন্ন সেক্টরের মতো শিল্প খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে। একই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হওয়াতে আদায়ও বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিতরণ করা শিল্পঋণের মধ্যে ৬ লাখ ৪১ হাজার ২৬৯ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এই অঙ্ক আগের বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালের মার্চে বকেয়া ছিল ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণের অঙ্ক ৯০ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ৯৮ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণ বিতরণ শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ বা ৩৯ কোটি টাকা কমেছে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ১৭ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে মেয়াদি ঋণ বিতরণের পরিমাণ যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯৪ ও ৫৬ দশমিক ২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও বৃহৎ শিল্পে ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। চলতি মূলধন ঋণ বিতরণের পরিমাণ ২০২১ সালের মার্চ প্রান্তিকে ছিল ৭৩ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। তবে এক বছর পর ৪১ দশমিক ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে এর পরিমাণ এক লাখ ৪ হাজার ৩৩০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে চলতি মূলধন ঋণ বিতরণের অঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৪৮ দশমিক ৮৩, ২১ দশমিক ৮৭ ও ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এক লাখ ২১ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকার শিল্পঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো।

স্টকমার্কেটবিডি.কম//

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *