শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ১৪টি ব্যাংকের নগদ অর্থ সংকট

bankস্টকমার্কেটবিডি প্রতিবেদক :

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ১৪টি ব্যাংকের নগদ অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো- ব্যাংক এশিয়া, যমুনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ট্রাস্টং ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকগুলোর সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাস শেষে এ ১৪ ব্যাংকের পরিচালন নগদ প্রবাহ বা অপারেটিং ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ার অর্থ ওই প্রতিষ্ঠানে নগদ অর্থের সংকট সৃষ্টি হওয়া। ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিতরণ করা ঋণ প্রত্যাশা অনুযায়ী আদায় না হওয়া পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

জানা যায়, কোন কোম্পানির কাছে কি পরিমাণ নগদ অর্থ আছে তা অপারেটিং ক্যাশ ফ্লোর মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। একাধিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে যাওয়া মানে ওই ব্যাংকটিতে নগদ অর্থের সংকট তৈরি হওয়া। শেয়ার প্রতি ক্যাশ ফ্লো (এনওসিএফপিএস) যত বেশি ঋণাত্মক, নগদ অর্থের সংকটও তত বেশি। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে ব্যাংকটিকে চড়া মাশুলে স্বল্প মেয়াদে টাকা ধার করতে হয়। তাতে খরচ বাড়ে। আর খরচ বাড়লে আয় কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।

তারা আরো বলেন, শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে যেকোনো কোম্পানির শেয়ার প্রতি ক্যাশ ফ্লোও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। এটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক অবস্থার ধারণা পাওয়া যায়। ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক মানে ওই কোম্পানির কাছে নগদ অর্থের ঘাটতি রয়েছে। আর ক্যাশ ফ্লো ইতিবাচক মানে হলো ওই কোম্পানির হাতে উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে।

নগদ অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে ঢাকা ব্যাংক। তাদের এনওসিএফপিএস ১৬.১৩ টাকা ঋণাত্মক। এর আগের বছর একই সময়ে এনওসিএফপিএস ৯.২৬ টাকা ঋণাত্মক ছিল।

এছাড়া অর্ধবার্ষিকে এনওসিএফপিএস ঋণাত্মক রয়েছে এমন ব্যাংকগুলোর মধ্যেেএবি ব্যাংকের ১০.৯০ টাকা; আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ৭.৯৬ টাকা; ব্যাংক এশিয়ার ৪.১২ টাকা; ডাচ বাংলা ব্যাংকের ১৩.৭৬ টাকা; এক্সিম ব্যাংকের ৭.৮৬ টাকা; আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ০.৩৭ টাকা; ইসলামী ব্যাংক ১০.৬২ টাকা; যমুনা ব্যাংক ৪.৯৩ টাকা; মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৩.০২ টাকা; ন্যাশনাল ব্যাংক ২.৭৫ টাকা; এসআইবিএল ১.৩২ টাকা; ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক ৯.৪২ টাকা ঋণাত্মক রয়েছে।

এদিকে ৪টি ব্যাংক নগদ অর্থের সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে সিটি ব্যাংকের এনওসিএফপিএস ১২.৯২ টাকা। এর আগের বছর একই সময়ে এনওসিএফপিএস ১০.৪৩ টাকা ঋণাত্মক ছিল। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এনওসিএফপিএস ৫.৭২ টাকা। আগে ০.৩৫ টাকা ঋণাত্মক ছিল। সাউথইস্ট ব্যাংকের এনওসিএফপিএস ৫.৮৪ টাকা। আগে ৪.৫৩ টাকা ঋণাত্মক ছিল। ট্রাস্ট ব্যাংকের এনওসিএফপিএস ১৮.৭২ টাকা। আগে ব্যাংকটির এনওসিএফপিএস ২৬.৫২ টাকা ঋণাত্মক ছিল।

এদিকে ২০১৮ বছরের অর্ধবার্ষিকে (জানুয়ারি-জুন) শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে ১৪টির মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। এদের মধ্যে এবি ব্যাংকের শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) আগের বছরের একই সময়ের তুলায় ৫১ শতাংশ কমে ০.৩৯ টাকা; আল আরাফাহ ব্যাংকের ৬২ শতাংশ কমে ০.৪৩ টাকা; সিটি ব্যাংকের ৩১ শতাংশ কমে ১.৫১ টাকা; ইস্টার্ন ব্যাংকের ২১ শতাংশ কমে ১.৮৩ টাকা; এক্সিম ব্যাংকের ৭০ শতাংশ কমে ০.১৩ টাকা; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৩৮ শতাংশ কমে ০.৫০ টাকা; আইএফআইসি’র ৩১ শতাংশ কমে ০.৪৩ টাকা; ওয়ান ব্যাংকের ৭৮ শতাংশ কমে ০.৪০ টাকা; প্রাইম ব্যাংকের ১০ শতাংশ কমে ০.৭০ টাকা; রূপালী ব্যাংকের ৩৩ শতাংশ কমে ০.৪৪ টাকা; স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৭৬ শতাংশ কমে ০.১০ টাকা; ট্রাস্ট ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ কমে ১.০৮ টাকা; ইউনাইটেড কমর্সিয়াল ব্যাংকের ১৬ শতাংশ কমে ১.০৫ টাকা এবং উত্তরা ব্যাংকের ইপিএস ৩৪ শতাংশ কমে ১.৩৮ টাকা হয়েছে।

২০১৮ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) অর্থাৎ তিন মাসে ১৩ ব্যাংকের মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। এদের মধ্যে এবি ব্যাংকের শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) আগের বছরের একই সময়ের তুলায় ৪৯ শতাংশ কমে ০.২৪ টাকা; আল আরাফাহ ব্যাংকের ৯৪ শতাংশ কমে ০.০৩ টাকা; সিটি ব্যাংকের ২৭ শতাংশ কমে ১.১১ টাকা; এক্সিম ব্যাংকের ৫২ শতাংশ কমে ০.৪৭ টাকা; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৮২ শতাংশ কমে ০.০৬ টাকা; আইএফআইসি’র ৫৯ শতাংশ কমে ০.১৬ টাকা; ওয়ান ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ কমে ০.০৯ টাকা; রূপালী ব্যাংকের ৩৯ শতাংশ কমে ০.১৭ টাকা; এসআইবিএলের ৭০ শতাংশ কমে ০.০৮ টাকা; স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮৮ শতাংশ কমে ০.০৩ টাকা; ট্রাস্ট ব্যাংকের ৭৭ শতাংশ কমে ০.২৫ টাকা; ইউনাইটেড কমর্সিয়াল ব্যাংকের ৩৬ শতাংশ কমে ০.৭৪ টাকা এবং উত্তরা ব্যাংকের ইপিএস ২৪ শতাংশ কমে ১.০০ টাকা হয়েছে।

এদিকে অর্ধবার্ষিকে ইপিএসে সেরা অবস্থানে রয়েছে ডাচ বাংলা ব্যাংক। তাদের ইপিএস আগের বছরের চেয়ে বেড়ে হয়েছে ৮.১৩ টাকা। এরপর রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। তাদের ইপিএস ২.৩৬ টাকা। এরপরই পূবালী ব্যাংক। এদের ইপিএস আগের বছরের তুলনায় ৮৯ শতাংম বেড়ে ২.১৭ টাকা হয়েছে। এছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ইপিএস ১.৯৪ টাকা; ইসলামী ব্যাংকের ইপিএস ১.৮৮ টাকা;ইস্টার্ন ব্যাংকের ইপিএস ১.৮৩ টাকা এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের ইপিএস ১.৭৩ টাকা হয়েছে।

অর্ধবার্ষিকে শেয়ার প্রতি প্রকৃত সমন্বিত সম্পদ (এনএভি) কমেছে ৫ ব্যাংকের। এগুলো হলো: ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক এবং পূবালী ব্যাংক।

গতকাল ২০১৮ বছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণায় ব্যাংকিংয়ে স্থিতিশীলতা আনতে তিনটি সংস্কার চাইলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, অনুকূল পরিস্থিতি টেকসই করতে আবশ্যিক এই তিন সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন না করা গেলে আর্থিক বাজারে আমানত ও ঋণের সুদহারে চাহিদা এবং জোগান ভিত্তিক পরিবর্তনশীলতা বাধাগ্রস্ত হবে।

তিনি বলেন, তিন সংস্কার না হলে মধ্যম আয় ও উন্নত অর্থনীতি পর্যায়ে দেশের প্রত্যাশিত উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বান্ধব হওয়ার পরিবর্তে প্রবৃদ্ধি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবশ্যিক জরুরি সংস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে, খেলাপি ঋণজনিত ব্যয়ভারসহ ব্যাংকের সামগ্রিক পরিচালনা ব্যয় দ্রুত কমানোর মাধ্যমে আমানত এবং ঋণের সুদহারের ব্যবধান কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, সরকারি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হার কমাতে হবে এবং মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের বাজার ইল্ড হার-এদুয়ের মধ্যে পার্থক্য যৌক্তিকীকরণ। তৃতীয়, সামগ্রিকভাবে মূল্যষ্ফীতি নিম্নামাত্রায় রাখার পরিবেশ সৃষ্টিকরতে হবে।

গভর্নর বলেন, সুদ হার কমানোকে কেন্দ্র করে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি সংস্থাসমূহের আমানতের সুদহারও রয়েছে নিম্ন মাত্রায়। উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধিধারা ধরে রাখার স্বার্থে ব্যাংকগুলো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঋণের গড় সুদহার এক অংকে রাখার সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রবাহের পর্যাপ্ততার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক নিবিড় নজরদারী বজায় রেখেছে।

নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি আগের মেয়াদের মুদ্রানীতির মতোই ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ রাখার কথা উল্লেখ করেন গভর্নর। মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

গভর্নর বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদ হার বেশি থাকার কারণে বেসরকারি ব্যাংকে আমানতে প্রবৃদ্ধি হার মন্থর হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা নিরসনে তিনি গত ১৫ এপ্রিল ব্যাংকগুলোর বিধিবদ্ধ জমার অনুপাত বা সিআরআর ১ শতাংশ কমিয়ে ৫.৫০ শতাংশ করেছেন। একইভাবে রেপো সুদ হার ০.৭৫ শতাংশ কমিয়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। গভর্নর বলেন, আগের মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, তা অর্জিত হয়নি। এ বছরের জুনে মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

এদিকে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর থেকে করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ইপিএস গতবারের তুলনায় বাড়বে।

স্টকমার্কেটবিডি.কম/বি/জেড

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *