শেয়ারবাজারের আলাদিন আবুল খায়ের হিরু!

স্টকমার্কেটবিডি ডেস্ক :

বছর দুয়েক আগেও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে আবুল খায়ের হিরুর নামটি খুব একটা পরিচিত ছিল না। তবে এ অল্প সময়ের মধ্যেই বর্তমানে শেয়ারবাজারে রীতিমতো তারকা খ্যাতি পেয়ে গিয়েছেন তিনি। এ মুহূর্তে দেশের শেয়ারবাজারের সবচেয়ে বেশি আলোচিত বড় বিনিয়োগকারী হয়ে উঠেছেন সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক আবুল খায়ের হিরু।

শেয়ারবাজারে এখন আবুল খায়ের হিরুর ভূমিকাকে তুলনা দেয়া হচ্ছে আরব্য রজনীর আলাদিনের সঙ্গে। বাজারে তার এতটাই প্রভাব, তিনি যে শেয়ারে হাত দিচ্ছেন, মুহূর্তের মধ্যে সেটির দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের কাছে তিনি রাতারাতি একজন বড় তারকা হয়ে উঠেছেন। তিনি কোন কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, সেটি জানার জন্যও বিনিয়োগকারীদের উৎসাহের কমতি নেই।

দেশের শেয়ারবাজারে এর আগেও বেশকিছু ব্যক্তি শ্রেণীর বিনিয়োগকারী আলোচিত হয়েছেন। তবে তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন ৩১তম বিসিএস সমবায়ের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হিরু। শেয়ারবাজারের পুরনো বিনিয়োগকারী ও বিনিয়োগ ব্যাংকাররাও তার এ উত্থানকে বর্ণনা করছেন বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব হিসেবে।

আবুল খায়ের হিরু প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন গত বছর বীমা খাতের শেয়ারে বিনিয়োগের মাধ্যমে। সেই সময় এক দফায় বীমা খাতের, বিশেষ করে সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর, শেয়ারদরে উল্লম্ফন ঘটে। সেবারই প্রথম একজন বড় বিনিয়োগকারী হিসেবে তার নাম সামনে আসে। এর পর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যে শেয়ারেই তিনি হাত দিয়েছেন, সেটিরই দাম বেড়েছে।

শুরুর দিকে সমবায়ের তহবিল শেয়ারবাজারে খাটানো শুরু করেছিলেন হিরু। তবে দ্রুতই তহবিল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ঈর্ষণীয় মুনাফা অর্জনের বিষয়টি বাজারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এতে অনেক বিনিয়োগকারী তার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি কখন কোন শেয়ার কিনছেন সেটির খবর জানার চেষ্টায় থাকেন তারা। এমনকি বাজারে জনশ্রুতি রয়েছে, বিত্তশালী অনেকেই তাদের তহবিল পুঁজিবাজারে খাটানোর জন্য হিরুকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনিও সফলভাবে সে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

আবুল খায়ের হিরুর কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রভাবে সাধারণ বীমা খাতের বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারদর আকাশচুম্বী হয়ে যায়। অবশ্য হিরু একা নন, এক্ষেত্রে তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ব্যক্তি শ্রেণীর বিনিয়োগকারী সঙ্গ দিয়েছেন। ওটিসি থেকে আসা কোম্পানি সোনালী পেপার, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস, ব্যাংক খাতের এনআরবিসি, বীমা খাতের ডেল্টা লাইফ, ট্যানারি খাতের ফরচুন সুজ, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের ন্যাশনাল ফিড এবং বস্ত্র খাতের মালেক স্পিনিং ও হামিদ ফ্যাব্রিকসের শেয়ারদর উত্থানের পেছনে হিরুর বড় অংকের বিনিয়োগের প্রভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

কোনো শেয়ারে হিরুর বিনিয়োগের প্রভাব কেমন, সেটি বুঝতে সেই শেয়ারের দামের দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওটিসি থেকে আসা কোম্পানি সোনালী পেপারের শেয়ারদর এ বছরের ২৭ জুন ছিল ১৯৭ টাকা ৪০ পয়সা। সর্বশেষ গতকাল এটি ৬৭৫ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ারদর এ বছরের ১২ মে ছিল ৫৪ টাকা ৭০ পয়সা। গতকাল শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ১৩৬ টাকা ১০ পয়সায়। এ বছর তালিকাভুক্ত হওয়া এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ারদর গত ২২ মার্চ ছিল ১৩ টাকা ২০ পয়সা। সর্বশেষ গতকাল এ শেয়ারটির দর হয়েছে ৩৪ টাকা ৯০ পয়সা।

ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার এ বছরের ৫ এপ্রিল ছিল ৬৪ টাকা। সেখান থেকে শেয়ারটির দর বেড়ে সর্বশেষ গতকাল ২১৫ টাকা ৪০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। ফরচুন সুজের শেয়ারদর এ বছরের ১৯ এপ্রিল ১৬ টাকা ২০ পয়সা ছিল। গতকাল শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ১১৭ টাকা ১০ পয়সায়। ন্যাশনাল ফিড মিলের শেয়ার গত ১১ এপ্রিল ১৪ টাকা ৬০ পয়সা ছিল। সেখান থেকে বেড়ে ২০ জুন শেয়ারটি ৪১ টাকা ৯০ পয়সায় দাঁড়ায়। অবশ্য এর পর থেকে শেয়ারটির দর কমতে থাকে এবং সর্বশেষ গতকাল ২২ টাকা ৯০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। মালেক স্পিনিংয়ের শেয়ারদর এ বছরের ১২ এপ্রিল ছিল ১৪ টাকা ২০ পয়সা। আর গতকাল শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ৩৮ টাকায়।

গত ২৮ অক্টোবর হামিদ ফ্যাব্রিকসের শেয়ারদর একদিনেই ৬৭ শতাংশ বেড়ে ১৮ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৩০ টাকা ৬০ পয়সায় উন্নীত হয়। সর্বশেষ গতকাল শেয়ারটির দর দাঁড়িয়েছে ৩৬ টাকা ৩০ পয়সায়।

আবুল খায়ের হিরুর বিনিয়োগ কৌশল ও মুনাফার বিষয়ে একজন বিনিয়োগ ব্যাংকারের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তিনি বলেন, করোনার আগেও হিরু কিছুই ছিলেন না। কিন্তু করোনার মধ্যে গত বছর তার বিস্ময়কর উত্থান দেখলাম। মনে হয় তিনি কোনো আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন। তিন দশক ধরে শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরও হিরুর মতো এত বড় তহবিল ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা আমি এখন পর্যন্ত অর্জন করতে পারিনি। এ সময় একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে হিরুর পক্ষে কীভাবে এত বড় তহবিল সংগ্রহ ও বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়েছে সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।

বিভিন্ন জায়গা থেকে হিরু তহবিল সংগ্রহ করে যেভাবে শেয়ারে বিনিয়োগ করে দাম বাড়াচ্ছেন, সেটিকে পনজি স্কিমের সঙ্গে তুলনা দিচ্ছেন অনেকেই। এ মুহূর্তে শেয়ারবাজারে হিরুর বিনিয়োগ কত, এ নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জল্পনাকল্পনার অন্ত নেই। কারো কারো মতে, ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ তার নিয়ন্ত্রণে। কারো মতে তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিনিয়োগের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকাও হতে পারে। তবে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ থেকে তার আয় যে ভালোই স্ফীত হয়েছে, সেটি স্পষ্ট। এরই মধ্যে তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান মোনার্ক হোল্ডিংস নামে একটি ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছেন। ব্রোকারেজটির চেয়ারম্যানের হিসেবে রয়েছেন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। সাকিবের সঙ্গেও হিরুর ভালো সখ্যতা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুজনকে একসঙ্গেও দেখা গিয়েছে। এমনকি হিরু ও সাকিব একসঙ্গে শেয়ারবাজারের কোম্পানিতে বিনিয়োগও করেছেন।

শেয়ারবাজারে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল খায়ের হিরু বণিক বার্তাকে বলেন, মানুষ তো কত কথাই বলে। সেই সব কি বিশ্বাসযোগ্য। পুঁজিবাজারে তার ভূমিকার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের ইন্টারমিডিয়ারিজ রয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে কেন এতদিন এ ধরনের ইন্টারমিডিয়ারিজ গড়ে ওঠেনি, সেটি আমার প্রশ্ন।

ডেল্টা লাইফের বিপুল পরিমাণ শেয়ার তিনি কিনেছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, হ্যাঁ আমি কোম্পানিটির কিছু শেয়ার কিনেছি। কিন্তু তা এত বেশি নয়। সূত্র : বণিক বার্তা

স্টকমার্কেটবিডি.কম/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *